অতৃপ্ততা | এম.এ মুহ্সী রহমান অর্ণব
সুন্দর ঝকঝকে সাদা বাড়িটার সামনের মাঠটাতে দাঁড়িয়ে আছি। বাড়িটার সামনের সাইনবোর্ডে লেখা, ‘প্রবীণ সেবাশ্রম’। ঘনসবুজ ঘাসে ছাওয়া মাঠটাতে ঘুরে বেড়াতে আমার বেশ লাগে। কী সুন্দর খোলা আকাশ, যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে। অনেক সুন্দর সুন্দর দেশি বিদেশি ফুলের গাছ। মাঝে মাঝে ঝুঁকে একেকটা ফুলের মিষ্টি সুঘ্রাণ নিই। আশেপাশের সবাই অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। হয়তো ভাবে, বুড়োর ভীমরতি ধরেছে। কিন্তু আমার নিজেকে কখনোই বুড়ো মনে হয়নি। বয়স ৭৪ হলেও, নতুন করে যেন চাঞ্চল্য আসছে আমার রক্তের মাঝে। কিন্তু একমাত্র ছেলের ও আয়েশার কথা ভেবেও মাঝে মাঝেই কেমন যেন কান্না কান্না ভাব চলে আসে। রোজ বিকালে মাঠটিতে খেলতে আসা ছোটো ছোটো বাচ্চাদের আদর করে সে বিমর্ষতা কাটানোর চেষ্টা করেও মাঝে মাঝে ব্যর্থ হই।
আরও পড়ুন: আড়ি | আবুল হাসনাত বাঁধন
স্মৃতির পাতায় উজ্জ্বল হয়ে আছে সে দিনটি যেদিন আমার আয়েশা আমাকে একটি ফুটফুটে সুন্দর ছেলে উপহার দেয়। সকলের চোখের মণি বলে নাম রাখি সোহাগ। সোহাগের কোনো চাহিদার কমতি রাখিনি। এমনকি নিজের পেনশনের সমস্ত টাকা দিয়ে তার বিদেশে পড়াশোনারও ব্যবস্থা করি। সে বিদেশে থাকা অবস্থাতেই হঠাৎ করেই আমার আয়েশা আমায় ছেড়ে চলে যায়। সোহাগেরও কোনো খোঁজ নেই। জীবনের ভয়াবহ নিঃসঙ্গতার দিনগুলো আমি চাইলেও আর ভুলতে পারি না।
এমনি সময়েই হঠাৎ করে সোহাগ আসে কয়েকজন লোক নিয়ে। নিয়ে এসেই বলে, ‘বাবা, ইনারা তোমার ফ্ল্যাটটা কিনেছেন। দশদিনের মধ্যে খালি করে দিতে হবে।’ আমি থ হয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘তাহলে আমি কোথায় থাকবে?’ ছেলে মৃদু হেসে বলেছিল, ‘সে তোমায় চিন্তা করতে হবে না বাবা। ধানমণ্ডিতে একটা সুন্দর বৃদ্ধাশ্রম আছে। ওখানকার কর্মীরা খুব যত্ন করে। আর তোমার তো সেটাই দরকার, তাই না?’ কুলাঙ্গার ছেলের অকাট্য যুক্তির কাছে অবশেষে হার মানতেই হয়। তারপর থেকেই আমার ঠিকানা ধানমণ্ডির ‘প্রবীণ সেবাশ্রম।’
আরও পড়ুন: দাফন | সানবির আলম
তারপর থেকে কয়েক বসন্ত পেরিয়ে গেল। গাছের পাতা ঝরল, নতুন পাতা গজালো। বৃষ্টিমুখর দিনে প্রকৃতি স্নানিত হলো, কিন্তু আমার ছেলেকে আজও আর দেখতে পেলাম না।
*****
হঠাৎ করেই নজর যায় আশ্রমের সামনের রাস্তাটার দিকে। একটা দামি ল্যান্ডরোভার গাড়ি এসে থেমেছে। পাঞ্জাবি জিন্স পরা এক মলিন চেহারার যুবক নামল গাড়িটি থেকে। আমি বেশ আগ্রহ নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারি নাড়ির টানে অবশেষে সে সাড়া দিয়েছে। শিশুসুলভ উন্মাদনা পেয়ে বসল আমার মাঝে।
আরও পড়ুন: বেনামি | রিফাত তানজিম চেতনা
বাতের ব্যথা ভুলে দৌড়ে আমার ছেলের সামনে এসে দাঁড়ালাম। কিন্তু, একি! সে কি আমায় না দেখার ভান করে পাশ কাটিয়ে গেল? এক কর্মীর কাছ থেকে আমার রুম নাম্বার জেনে নিয়ে সে হাঁটতে শুরু করল আমার রুমের দিকে। আমি প্রায় হতভম্ব হয়ে তার পিছু পিছু রুমে আসলাম। ঢুকে দেখি সেখানে কয়েকজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছেন বিমর্ষ ভঙ্গিতে। তাদের মাঝে আশ্রম প্রধানও আছেন।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী হয়েছে, ভাই?’ আমার কথা বোধহয় তিনি শুনতে পেলেন না। তিনি বিছানার সাদা চাদরটি সরিয়ে ফেললেন। চাদরটি দিয়ে একজন মানুষের সারা শরীর ঢাকা দেওয়া ছিল। এবার আমার আরেক দফা হতভম্ব হওয়ার পালা। আমার ছেলে ‘বাবা, বাবা’ বলে আর্তনাদ করতে করতে সে মানুষটির কাছে ছুটে যায় আর বলে, ‘বাবা, তুমি ওঠো। আমি নিতে এসেছি তোমায়, বাবা।’
আরও পড়ুন: ধুপপানি ঝরনা ভ্রমণ | প্রসেনজিৎ পাল
আমি দেখে খুব বড়ো একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম, ‘বাবা সোহাগ, বড্ড দেরি করে ফেললি রে। ইশশশ! বেঁচে থেকে যদি তোর মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করতে পারতাম, তাহলে নিজেকে সবচেয়ে সুখী পিতা বলে মনে হতো।’ পাঞ্জাবির হাতা দিয়ে চোখ মুছলাম। রাস্তা থেকে মাইকের তীব্র আওয়াজ ভেসে আসছে, ‘একটি শোক সংবাদ! একটি শোক সংবাদ! ধানমণ্ডিনিবাসী ব্যাংকার আফজাল খান গত রাত্রে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে প্রবীণ সেবাশ্রমে ইন্তেকাল করেছেন। ইন্নালিল্লাহি…’
গল্প: অতৃপ্ততা
লেখক: এম.এ মুহ্সী রহমান অর্ণব
প্রথম প্রকাশ: গল্পীয়ান ও সাহিত্যের সাতকাহন সম্পাদিত গল্প সংকলন ‘গল্পোদ্যান’ এ প্রকাশিত।
*****
প্রিয় পাঠক, ‘অতৃপ্ততা’ – গল্পটি ভালো লাগলে পরিচিত বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন। এম.এ মুহ্সী রহমান অর্ণবের লেখা ‘অতৃপ্ততা’ এর মতন আরও নতুন নতুন গল্প পড়তে চাইলে উইকিহাউ৩৬০ তে চোখ রাখুন।
[…] আরও পড়ুন: অতৃপ্ততা | এম.এ মুহ্সী রহমান অর্ণব […]
[…] আরও পড়ুন: অতৃপ্ততা | এম.এ মুহ্সী রহমান অর্ণব […]