ধুপপানি ঝরনা ভ্রমণ | প্রসেনজিৎ পাল

ধুপ শব্দের অর্থ সাদা, তার সাথে পানি মিশিয়ে ধুপপানি। এই দুইয়ের মিশেলে অপূর্ব সৌন্দর্য নিয়ে দূর পাহাড়ে, একাকি নিরন্তর ঝরে পড়া ধুপপানি নামের অপূর্ব ঝরনাটির। দূর থেকে যখন চোখে পড়বে, মনে হবে যেন শরতের সাদা মেঘ কন্যার দল আকাশের সাথে অভিমান করে পাহাড় বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে।
ঝরনাটির চারপাশে খাঁড়া পাহাড়। ওপরে প্রার্থনাগৃহ আছে ভিক্ষুদের। ঘণ্টা দুইয়ের ক্লান্ত তপ্ত চোখ যখন প্রথম ঝরনাটিকে দেখবে এক লহমায় প্রেমে পড়তে বাধ্য এটা হলফ করে বলা যায়। ভাগ্য ভালো থাকলে আপনাকে স্বাগত জানাবে এক ঝলক দুরন্ত হাওয়া, ওপরের পাহাড় থেকে যখন একরাশ শুকনো হলুদ পাতা শুভেচ্ছা জানাতে ঝরে পড়বে, মনে হবে পেছনের শুভ্র দেয়ালের ক্যানভাসে কোনো শিল্পী সযত্নে এঁকেছে হাজারো উড়ন্ত হলুদ প্রজাপতি। সে এক স্বর্গীয় ব্যাপার, সেখানটায় দাঁড়িয়ে না দেখলে এই ব্যাপারটা বোঝা যাবে না।
আরও পড়ুন: জোছনাযুদ্ধ | সোহেল নওরোজ
তাই আপনি যদি ট্র্যাকিং ভালোবাসেন, যদি পাহাড় আপনাকে টানে, যদি অ্যাডভেঞ্চার এর প্রয়োজন হয় যান্ত্রিক জীবনে; তাহলে, ধুপপানি ঝরনা আপনার ভ্রমণ করার জন্য হতে পারে আদর্শ জায়গা। এর সাথে বোনাস হিসেবে পাবেন, মুপ্পোছড়া আর ন-কাটা ঝরনা। ধুপপানিতে যাওয়ার পথটা অসাধারণ। আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথের মাঝখানে হঠাৎ হঠাৎ মিনিট দশেকের জন্য ঝিরিপথ পড়বে। এরা যেন মুসাফিরের শ্রান্তি শুষে নেওয়ার জন্যই তৈরি।

Table of Contents:
ধুপপানি ঝরনা ভ্রমণ : যাত্রা শুরু
ধুপপানি গেলে সাথে মুপ্পোছড়া আর ন-কাটা দেখে আসাই ভালো। যেদিন যাবেন, সেদিন মুপ্পোছড়া আর ন-কাটা দেখে, পরের দিন ধুপপানি এবং সেদিন সন্ধ্যার মধ্যেই কাপ্তাই ফিরতে হবে। রাতের বাসেই ফিরে যেতে পারবেন গন্তব্যে। প্রথমেই যেতে হবে কাপ্তাই। ঢাকা থেকে কাপ্তাইয়ের সরাসরি বাস আছে। শ্যামলী কিংবা হানিফ পরিবহনে যেতে পারেন। চট্টগ্রাম টু কাপ্তাই লোকাল গাড়ি অথবা সিএনজি যোগে আসা যায়। কাপ্তাই থেকেই মূলত যাত্রা শুরু হবে। কাপ্তাই ঘাট অথবা নেভি ক্যাম্পের ভেতরে এসএসডি ঘাট থেকে নৌকা ছাড়বে। এই সুযোগে নেভি ক্যাম্পও ঘুরে দেখতে পারেন।
আরও পড়ুন: আড়ি | আবুল হাসনাত বাঁধন
নৌকা ভাড়া করা যাবে ওখান থেকেই। যদি ভেঙে ভেঙে যেতে চান, তাহলে বিলাইছড়ি পর্যন্ত ১০০০-১৫০০ টাকা মতো পড়বে। বলবেন- হাসপাতাল ঘাটে নামিয়ে দিতে। ওখানে উঠতে পারেন, হোটেল নিরিবিলিতে। সে ক্ষেত্রে খাবারটা বাইরে খেতে হবে। আর যদি থাকা খাওয়া নিয়ে দুই দিনের জন্য কোনো ঝামেলা না চান এবং লেকের ধারে জলের ওপর চমৎকার বারান্দাওয়ালা কটেজে থাকতে চান, তবে নিচে কটেজ এর দাদার নাম্বার সংযোজন করে দেবো। সেখানে যোগাযোগ করলে, শুধু কটেজ নয়, সাথে তিনি ব্যবস্থা করে দিতে পারবেন রিজার্ভ নৌকা ও গাইডের।

কাপ্তাই ঘাট থেকে শুরু অ্যাডভেঞ্চার:
কাপ্তাই ঘাট থেকে বেলা দশটায় নৌকায় চড়লে কটেজে পৌঁছাতে পৌঁছাতে দুপুর গড়াবে। কারণ জায়গায় জায়গায় চেকিং এর ব্যাপার থাকবে। এবং এ ক্ষেত্রে যেটা অবশ্যই সাথে করে নিতে হবে তা হলো, জাতীয় পরিচয়পত্র অথবা জন্ম নিবন্ধন কার্ডের ফটোকপি। এগুলো কোনোটাই যদি সাথে না নিয়ে যান, তাহলে কিন্তু বিপদে পড়বেন। ফিরেও আসতে হতে পারে।

দুপুরে কটেজে পৌঁছেই ফ্রেশ হয়ে দুপুরের খাবার খেয়ে নেবেন। তারপর দেরি না করে রওনা হয়ে যাবেন, মুপ্পোছড়া ও ন-কাটার উদ্দেশ্যে। বোটেই বেশ কিছুক্ষণ বিশ্রাম হবে যাবে, কাপ্তাই লেকের চমৎকার বাতাসে। বাড়তি জামা কাপড় আলাদা করে নেওয়ার প্রয়োজন নেই, তবে সাথে কিছু টাকা রাখতে পারেন। কারণ যেখান থেকে হাঁটা পথ শুরু হবে সেখানে একটা পাড়া এবং কিছু দোকান পড়বে। হালকা জলযোগ করে নিতে পারেন সেখান থেকে।
মুপ্পোছড়া যাওয়ার পথটা অসাধারণ। কিছুটা ঝিরিপথ আর বাকিটা জঙ্গলের ভেতর দিয়ে পাহাড়ি রাস্তা। গাইডকে বললেই শক্ত পাহাড়ি গাছের লাঠি বানিয়ে দেবে। এগুলো পথ চলায় ভীষণ কাজে দেবে। আসার পথটা পুরোটাই ঝিরিপথ।
আরও পড়ুন: আত্মজা | আবুল হাসনাত বাঁধন
মুপ্পোছড়া আর ন-কাটা দেখে এসে আদাম অর্থাৎ পাড়ার দোকানের চা আপনাকে অপার্থিব অনুভূতি দেবে। গ্রুপ ট্যুরে গেলে আগে থেকে লেবুর শরবতের অর্ডার দিয়ে যেতে পারেন দোকানে। ফেরার পথে সবাই বোটের ছাদে বসে লেকে সূর্যাস্ত দেখতে দেখতে ফিরে আসবেন।
সন্ধ্যায় ফিরে এসে ফ্রেশ হয়ে বারান্দায় গিয়ে বসবেন। আকাশের দিকে তাকালেই সপ্তর্ষিমণ্ডল মুগ্ধতা ছড়াবে। বোটম্যানকে রাজি করাতে পারলে রাতের বেলায় চমৎকার নৌবিহারও হয়ে যেতে পারে।
ধুপপানির পথে:
ভোরেই ছাড়তে হবে বিছানা। কয়টায় বেরোবেন সেটা বলে রাখতে হবে বোটম্যান এবং কটেজের দাদাকে। কারণ সেই অনুযায়ী সকালের খাবার তৈরি থাকবে। সবকিছু গোছগাছ করে একেবারে বোটে উঠে যাবেন। ধুপপানি থেকে এই বোটটি আপনাকে কাপ্তাই ঘাটে নামিয়ে দেবে। সকালে বের হলে ভ্রমণটা আনন্দময় হবে। সকালে রোদের তাপ কম থাকে! আর তা ছাড়াও চেকিং এর জন্যও বেশ কিছুটা সময় লাগে। দুপুরের খাবারের জন্য যাওয়ার সময় খালার দোকানে খাবারের অর্ডার দিয়ে যাবেন। মাঝিকে বললেই পথে খালার দোকান চিনিয়ে দেবে। আগে থেকে অর্ডার না দিয়ে গেলে কিন্তু দুপুরের খাবার পাওয়া যাবে না। প্রচণ্ড খিদের জন্য কিনা জানি না, খাবারটা অসাধারণ লাগতে বাধ্য।

প্রথমেই উলুছড়িতে বিরতি। সেখানে চা খেয়ে নিতে পারেন কারণ কটেজে চা পাওয়া যাবে না। সেখান থেকে ডিঙি নৌকায় যাত্রা। এক নৌকায় পাঁচ জনের সওয়ারি। ব্যাগপত্র নৌকায় রেখে যাবেন এবং সাথে অবশ্যই কিছু টাকা রাখবেন। কারণ অনেক ভেতরেও বেশ কিছু দোকান পাবেন। যেখানে পাওয়া যাবে সেদ্ধ ডিম, পাহাড়ি শসাসহ আরও বেশ কিছু খাবার।

ডিঙি নৌকায় পনের মিনিটের ভ্রমণ শেষে প্রথম পয়েন্টে পৌঁছে যাবেন। সেখান থেকে আড়াই ঘণ্টার হাঁটাপথ। চোখে পড়বে আদিবাসীদের মাচাং ঘর, জুমের খেত, সবুজ পাহাড়, ধুধু মাঠ। অবিরাম সবুজের মাঝে হঠাৎ বনফুল মুগ্ধতা ছড়াবে। মাঝে মাঝে কখনো খাঁড়া পাহাড় বেয়ে উঠতে হবে। কখনো হঠাৎ ক্লান্তিহারিনি ঝিরিপথের উদয় হবে। একসময় পৌঁছে যাবেন ধুপপানিতে।

শুভ্র সেই ঝরনা আপনাকে স্বাগত জানাবে একরাশ হলুদ পত্রবৃষ্টি দিয়ে। ঝরনার কাছে একটা পাথরের ওপর একটা সবুজ সাপ চোখে পড়বে। অদ্ভুত ব্যাপার সাপটি স্থান পরিবর্তন করে না। যেন অনন্তকালের ধ্যানে মত্ত সে। তার ওপর যেন দায়িত্ব পড়েছে ধুপপানিকে দেখে রাখার।
শীতল জলে ক্লান্তি ধুয়ে, ঝরনার পেছনের গুহায় বসে থাকতে পারেন। সামনে ঝরে পড়বে একহারা গতিতে শুভ্র জল। চেষ্টা করবেন তিনটার মধ্যে খালার দোকানে পৌঁছে গিয়ে দুপুরের খাবার খেয়ে নিতে। সেখান থেকে সন্ধ্যার মধ্যে আবার পৌঁছে যাবেন কাপ্তাই ঘাটে।
আরও পড়ুন: বই পড়ার মধ্যমে হতাশা থেকে মুক্তি!
*********
কটেজ মালিকের ফোন নাম্বার: ০১৫৫২৭০৫২২৫ (শান্ত দা, আমাদের রিজার্ভ বোটের ব্যবস্থা উনিই করে দিয়েছিলেন। এখানে একই সাথে থাকা খাওয়া দুটোই হয়ে যাবে। অনেকটা হোম স্টে এর মতো।)
নিরিবিলি বোর্ডিং এর নাম্বার: ০১৫৫৩১২৮৬৭৩ (ডাবল বেড ৫০০, সিঙেল বেড ৩০০ টাকা)
যা যা অবশ্যই নিতে হবে:
১। জন্ম নিবন্ধন অথবা জাতীয় পরিচয় পত্রের ফটোকপি ৬ কপি করে। ৬টা কাগজে সবার নাম আর ফোন নাম্বার লিখে রাখলে চেক পয়েন্ট গুলোতে সময় বাঁচবে।
২। শুকনো খাবার।
৩। ফার্স্ট অ্যাইড কিটস।
৪। যথেষ্ট পরিমাণ পলিথিন।
৫। ফোনের জন্য ওয়াটারপ্রুফ ব্যাগ।
৬। Odomos Cream, মশার ঔষধ।
৭। পাওয়ার ব্যাংক।
৮। ট্র্যাকিং উপযোগী স্যান্ডেল। (পেগাসাস এর জুতার দাম পড়বে ১২০ টাকা।)
৯। সম্ভব হলে একটা ছাতা সাথে নিতে পারেন। অনেক কাজে দেবে।
বি. দ্র: ঘুরতে গিয়ে পদচিহ্ন ছাড়া আর কিছু ফেলে আসবেন না। নির্দিষ্ট জায়গায় আবর্জনা ফেলবেন। সম্ভব হলে নিজের সাথে নিয়ে আসবেন। প্রকৃতিকে একদম বুনো, নিজের মতো থাকতে দিন। বহু মানুষের ক্লান্তিহরণের খোরাক এরা।
ধুপপানি ঝরনা ভ্রমণ
লেখা: প্রসেনজিৎ পাল
আরও পড়ুন: সেরা ৬টি ফ্রিল্যান্সিং মার্কেটপ্লেস!
[…] আরও পড়ুন: ধুপপানি ঝরনা ভ্রমণ | প্রসেনজিৎ পাল […]
[…] আরও পড়ুন: ধুপপানি ঝরনা ভ্রমণ | প্রসেনজিৎ পাল […]